কিয়ামতের মাঠে কোটি কোটি অপরাধের মধ্যে আল্লাহ তা’য়ালা সর্বপ্রথম কোন অপরাধের বিচার কাজ শুরু করবেন বিষয়টি আপনি কখনো ভেবেছেন কি? এ বিষয়ে হাদিস শরীফে স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। আল কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলো।
ইসলামে নরহত্যাকে নিষিদ্ধ করে সব ধরনের হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের মাঠে মূলত এই হত্যাকাণ্ডের বিচারই সর্বপ্রথম শুরু করবেন।
সাময়িক উত্তেজনা বা সস্তা আবেগের বশবর্তীতে কাউকে অপহরণ, গুম, খুন, গুপ্তহত্যা, নানাবিধ নির্যাতন করে মারার মতো বাড়াবাড়ির অবকাশ ইসলামে নেই। এমনকি হত্যার প্রারম্ভিক বিষয় তথা অস্ত্র দিয়েও কাউকে ভয় দেখাতেও নিষেধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক না করে। কারণ সে জানে না, হয়ত শয়তান তার হাত থেকে তা বের করে দিতে পারে, ফলে সে জাহান্নামের গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে।’ -সহিহ বোখারি
কাউকে হত্যা করা সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের অন্তর্ভুক্ত। নিজের স্বার্থ হাসিলের মোহে প্রতিশোধ গ্রহণের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা নিরপরাধ মানুষ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তারা মানবতাবর্জিত। পবিত্র কোরআনে নরহত্যাকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করো না।’ -সূরা বনি ইসরাইল: ৩৩
বিশ্বের সকল ধর্ম নরহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। নিরীহ মানুষকে অহেতুক মেরে ফেলার চেয়ে ভয়াবহ পাপ আর সমাজে নেই। ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী হলো, ‘নরহত্যা মহাপাপ।’ নরহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে ইসলামি শরিয়তের দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলা উচিত এবং অন্যকেও ধর্মীয় জীবনযাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। মানুষ যত বেশি নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবে, তাদের জীবন থেকে তত বেশি অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে।
হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে করলে হয় প্রকাশ্য হত্যা, আর গোপনে করলে হয় গুপ্তহত্যা। উভয় হত্যাকাণ্ডের শাস্তি একই- মৃত্যুদণ্ড। প্রকাশ্যে বা গোপনে যেভাবেই হোক, হত্যাকারীকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে দুনিয়ার আদালতে এর ন্যায়বিচার করতে হবে। নতুবা তাকে আখেরাতের আদালতে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
পবিত্র কোরআনে হত্যাকাণ্ডকে মহাপাপ সাব্যস্ত করে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জাহান্নামে শাস্তির কঠোর বিধান সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা। …আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ -সূরা আন নিসা: ৯২-৯৩
হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রীয় আইনে একটি ভয়াবহ অপরাধ, তেমনি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতেও জঘন্যতম অপরাধ। এ ধরনের অমানবিকতা দূর করতে হলে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করতে হবে। খোদাভীতি মনে থাকলে মানুষ কখনো কাউকে হত্যা করবে না। পরকালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করার অনুভূতি জাগ্রত থাকলে মানুষের মধ্যে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যায়। কারণ, মানুষ জানে, তাকে একদিন আল্লাহর সামনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তখন নরহত্যার মতো মহাপাপের কথা জিজ্ঞাসা করলে সে কী জবাব দেবে?
মানুষের অন্তরের এই অনুভূতি অন্যায় কাজ করতে বাধা দেয়। নরহত্যার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল।’ -সূরা আল মায়িদা: ৩২
ভয়ানক নরহত্যার জঘন্যতা ও হত্যাকারীর জন্য কঠোর শাস্তির কথা হাদিস শরিফেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ –সুনানে তিরমিজি
কিয়ামতের দিন নরহত্যার বিচার করা হবে সবার আগে। তারপর অন্যান্য অপরাধের বিচার করা হবে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা হবে, তাহলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
অন্যায়ভাবে একজন মানুষ হত্যা করাকে কোরআনে কারিমে ‘সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার’ নামান্তর আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে এবং যে কারো জীবনরক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ -সূরা আল মায়েদা : ৩২
হত্যার প্ররোচক কারণ হিসেবে হিংসা-বিদ্বেষ-ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছে ইসলাম। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করো না, হিংসা করো না এবং একে অপরের পেছনে পড়ো না। আল্লাহর বান্দা সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইকে তিনদিনের বেশি ত্যাগ করা হালাল নয়।